নতুন বাংলাদেশ হোক যুক্তরাষ্ট্রীয়: আসুক সুশাসন ও অর্থবহ গণতন্ত্র


Shikha BD প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৪, ৯:৪৩ অপরাহ্ন /
নতুন বাংলাদেশ হোক যুক্তরাষ্ট্রীয়: আসুক সুশাসন ও অর্থবহ গণতন্ত্র

ডেস্ক নিউজ : বাকস্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই আমলে জানা যাচ্ছে যে পুলিশের ওসিরা শুধু ঢাকার যেকোনও এক থানায় বদলি নিতে দুই কোটি টাকা ঘুষ দিতো। এমনটা এখন আর কোনও গল্প নয়; বেনজীরসহ পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের সম্পদের বহর দেখলে বোঝা যায়, এই ঘটনা কোনও রটনা নয়। শুধু পুলিশ কেন? বেশিরভাগ নির্বাহী বিভাগের আমলা, ডাক্তার, বিচারক, শিক্ষক সবাই ঢাকায় আসতে মরিয়া। অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলেও আর্থিক বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধার চাহিদা যে এখানে মুখ্য, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না।

বাংলাদেশ যেন শুধুই ‘ঢাকা’! ঢাকাতে গ্রামীণফোনের অফিসও থাকতে হবে, আবার বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দফতরও রাখতে হবে। অথচ দুটোর কোনোটাই ঢাকাতে রাখার যৌক্তিকতা ছিল না। অসম উন্নয়নের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ঢাকার আজকের অবস্থান। যাবতীয় সরকারি অফিস ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর দিয়ে ঢাকাকে ভরিয়ে রাখা। তাই যাবতীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন- ভালো স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, শপিং মল সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারি বা বেসরকারি, কোনোভাবেই দেশের কিছু বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি।

এমনকি অষ্টম সংশোধনী বাতিলের রায় যেসব সমালোচনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল কেন্দ্রিককরণের দোহাই দিয়ে ঢাকার প্রতি পক্ষপাত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্রের মধ্যে ‘এক গভীর সম্পর্ক’ অঙ্কিত হয়েছিল ওই রায়ে। সেই বিতর্ক বা সমালোচনা এখনও জারি আছে। এখনও অনেকেই মনে করেন যে এরশাদ সরকার যেসব কাজ করে গেছেন, তার মধ্যে অষ্টম সংশোধনী অন্যতম ছিল, যার মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায়ে ওই সংশোধনী টেকেনি। বাজারে আলোচনা ছিল যে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ঢাকা ছাড়তে চান না; তাই ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থায়ী করলে তাদের বিস্তর অসুবিধা।

বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলোর শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ঢাকার কিছু বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ সুবিধা বরাদ্দের মাধ্যমে তাদের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারগুলোর কর্তাব্যক্তিদের হোমডিসট্রিক্ট হওয়ার কারণে গোপালগঞ্জ, বগুড়া আর রংপুরে অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি বাজেট ও প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

শুধু স্থাপনা নয়, এসব অঞ্চলের বাসিন্দারা তাদের আঞ্চলিকতার জন্য রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কতিপয় অঞ্চল উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে শুধু সরকার প্রধানদের ব্যক্তিগত ইচ্ছায়। অন্য অঞ্চলগুলোর যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও থেকে গেছে অনুন্নত ও অবহেলিত। কোনও সাংবিধানিক পরিকাঠামো না থাকায় রাষ্ট্রের জেলাসমূহকে নির্ভর করতে হয় রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছার ওপর। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বাপের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি না হলেও, প্রভাবশালী মন্ত্রীর বাড়ির এলাকাতেও কিছুটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।

যেসব জেলায় সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা থাকেন না, সেখানে পৌঁছায়ও না উন্নয়নের ছোঁয়া।

বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অর্থাৎ ১০নং অনুচ্ছেদে সমাজতন্ত্র ও শোষণ থেকে মুক্তির কথা ও ১৬নং অনুচ্ছেদে গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্রের অনেক জেলায় এখনও সরকারের সুষম উন্নয়ন হয়নি। বাংলাদেশ যদিও সাংবিধানিকভাবে এখনও এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রয়োগ সম্ভব। যেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান তৈরির জোরালো দাবি উঠেছে, তাই সেখানে সুশাসন নিশ্চিত করতে ও রাষ্ট্রের সব এলাকার সুষম উন্নয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বিধান রাখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে সরকারের নির্বাহী কাজের জন্য যে ‘বিভাগ’ তৈরি করা হয়েছে বা স্থানীয় সরকারের দোহাই দিয়ে যে জেলা ও উপজেলা, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা রাখা হয়েছে, তা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সুশাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অগণতান্ত্রিক এসব প্রতিষ্ঠান কখনও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহতে পরিণত হয়েছে। এদের আক্ষরিক অর্থে তেমন কোনও রাজনৈতিক বা আইনি ক্ষমতা না থাকার কারণে, এরা স্থানীয় অঞ্চলগুলোতে সুশাসন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এদের সেই অর্থে কোনও জবাবদিহিও নেই। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা অনেকাংশেই অর্থবহ বিকেন্দ্রীকরণ বুঝতে ব্যর্থ। লন্ডন সিটি করপোরেশন আর স্কটল্যান্ডের সরকার কাঠামো যে এক নয়, তা বোধহয় তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি।

আমাদের দেশের সংসদ সদস্যদের যদিও শুধু আইন প্রণয়নের দায়িত্বে রাখা, কিন্তু তারা স্থানীয় সরকারের যাবতীয় কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে। তাই স্থানীয় সরকারের যতটুকু ক্ষমতা থাকে, ততটুকুও তারা বাস্তবায়ন করতে পারে না। অন্যদিকে এমপিরা বিক্ষিপ্তভাবে ও তাদের সুবিধামতো স্থানীয় বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করে। যেহেতু তাদের মূল কাজ সংসদ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া, তাই তারা নিজ অঞ্চলের চাইতে ঢাকাতে বেশি ব্যস্ত থাকেন। এমনও অভিযোগ শোনা যায়, কোনও কোনও এমপি পাঁচ বছরে একবারের জন্যও নিজ এলাকায় যায়নি। এমন জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি বাংলাদেশে অপরিচিত নয়। শুধু কাঠামোগত সুবিধার জন্য নয়, বরং জনগণের অনেক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বিকল্প নেই।

অনেকের ভ্রান্ত ধারণা থাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বোধহয় শুধু বড় রাষ্ট্রগুলোর জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তার এটা সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা। প্রাদেশিক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রের সীমানা কোনও তাৎপর্য রাখে না। আমেরিকা বা রাশিয়াতেও সাংবিধানিক যুক্তরাষ্ট্র যেমনি বিদ্যমান, তেমনি সুইজারল্যান্ডের মতো ছোট রাষ্ট্রে অঞ্চলভিত্তিক ক্যান্টন তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চালু করা আছে। মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্র আসলে তার নাগরিককে মূলত শাসন করে বা সেবা দেয়, কোনও ভূমি বা পাহাড়-পর্বতকে নয়।

রাষ্ট্রের সমগ্র অঞ্চলকে কয়েকটা প্রদেশে ভাগ করে যদি প্রাদেশিক সরকারের ব্যবস্থা করা যায়, তবে প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে অঞ্চলগুলোতে যথেষ্ট উন্নয়ন করা সম্ভব। জনগণের অধিকার তাদের দোরগোড়াতে পৌঁছানো সম্ভব। প্রাদেশিক সরকারের সবচেয়ে বড় দর্শনগত সুবিধা হচ্ছে, এমন সরকারকে মানুষ নিজেদের সরকার ভাবে। জনগণের ভোটে এমন সরকাররাও তাই কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজেদের ওপর ন্যস্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনুযায়ী নিজ প্রদেশের উন্নয়নে ব্যস্ত থাকে।

প্রাদেশিক সরকারের অন্যতম সুবিধা হচ্ছে এখানে সাধারণত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট রাখার সুবিধা থাকে। অতি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে এককক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টকে একচেটিয়া প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে না। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের নিম্নসভা ও উচ্চসভাতে যে কোনও বিল নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা ও পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দেওয়ার রেওয়াজ থাকে। এমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেকোনও আইনেরই পরিশীলিত ও জনবান্ধব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাদেশিক সরকার থাকলে রাষ্ট্রের উচ্চ আদালতের শাখাকে বা হাইকোর্টকে প্রত্যেকটা প্রদেশে স্থাপিত করা সম্ভব। এমন বিচারিক ব্যবস্থার সুফল রাষ্ট্রের প্রান্তিক জনগণের কাছে সহজেই পৌঁছাবে।

সুশাসনের পাশাপাশি প্রাদেশিক সরকার যেকোনও রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্র চর্চায় ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা প্রদেশে তার মতো কোনও নির্বাচন আইন রাখা সম্ভব। যেমনটা আমেরিকাতে বিদ্যমান। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন দিনে তারা তাদের নির্বাচন পরিচালনা করতে পারঙ্গম থাকবে। এতে নির্বাচনে শৃঙ্খলার পাশাপাশি ভোট গণনাও সুষ্ঠু করা সহজ হবে।

আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, প্রদেশগুলো তাদের মতো করে রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবে। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয়/বৃহৎ দলগুলোর অগণতান্ত্রিক চর্চা স্থানীয় নেতৃত্বরা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এতে স্থানীয় জনগণ বা উক্ত দলের কর্মীরা তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বদের ওপর আস্থা হারালেও তাদের অন্য রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। মানুষ এমন দলগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। কিন্তু যেসব রাষ্ট্রে প্রাদেশিক সরকার থাকে সেখানে জাতীয় দলগুলোকেও আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেকোনও গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গলজনক।
নতুন সংবিধানে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ভাবতে গেলে, প্রথমেই আনতে হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা। তাহলেই শুধু যাবতীয় ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা ও সরকারের কর্তৃত্ববাদিতা রুখে দেওয়া সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।